ধর্ম বিচার
তথ্যপঞ্জী থেকে
Published on : 5/25/2021 1:11:00 AM
মেঘাচ্ছন্ন ভোর। মন্দিরের গাম্ভীর্য আজ আরও বেশি। গাজনের সন্ন্যাসীরা চুপচাপ, কেউ কেউ চিন্তিতও। প্রাতঃপূজান্তে স্বয়ং ধর্মাধিকারিক বিচার করবেন বালার। বালা নিজেও ন্যায়-নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ, হিন্দুরীতি জেনেছেন এবং অভ্যাস করেছেন দুজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণের কাছে। একজন স্বয়ং ধর্মাধিকারিক, তাঁর পিতাঠাকুর। অপরজন বালার মাতামহ, কাশিতে সংস্কৃত অধ্যপনায় নিযুক্ত ব্রাহ্মণ। এরপরও এত বড় অনাচার!
গত রাতে লোহজং তারপাশা হাটের পতিতাপল্লীর সার্বজনীন আঙিনায় গাজনের সন্ন্যাসীরা "কাচ খেলে" এসেছে। "কাচ-খেলা"র অর্থ শিব-গৌরী-কালী-অসুর-দুর্গা-কৃষ্ণ-অষ্টসখী ইত্যাদি সেজে নাচ, গান, গুণকীর্তন করা। হাটের প্রজাদের অনুরোধে হাটে এই নাচের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছরই। প্রজারা সাক্ষাৎ শিবজ্ঞানে যথাবিধি পা-ধুইয়ে, ফল-ফুল-মিষ্টি দিয়ে সন্ন্যাসীদের পুজা করেন। মাঙন দেন। এই তরফের বাবুরা ঠিক জমিদারগোছের নন বলে কর আদায়ের তাগাদাও থাকে না বিশেষ। প্রজাদের পক্ষপাতিত্বও তাই এই তরফের প্রতি একটু বেশিই। সেটাও নিষ্ঠার রূপ ধরে এই চৈত্র মাসে, নীলপুজোর সময়। সেই প্রজারাও অনেকেই আজ ভোরে এসেছে পায়ে হেঁটেই, চৌদ্দ মাইল পথ উজিয়ে। লোহজং থেকে বিক্রমপুর চৌদ্দ মাইলের পথ।
প্রজারাও মেনে নিতে পারছেন না মন থেকে এই অনাচার। আয়োজনের কি এমন ত্রুটি ছিল? সম্ভবতঃ বালার বয়স নিতান্ত অল্প বলেই বালার এই ধর্মচ্যুতি। নাহলে কেই ওই মহিলাদের হাতে মাঙন নেয়!
তবু ছিঃ ছিঃ করেন নি কেউ। কাঁচখেকো দেবতা! তাঁর পূজার বালা বলে কথা! তাছাড়া অতি বড় শত্রুও চরিত্রদোষ দিতে পারবে না বালার। সুতরাং কৌতুহল আছে কি কারণ তা জানার। ছিঃ ছিঃ করেন নি তাই কেউ, কিন্তু আশঙ্কা একটা আছেই। আছে অভিমানও, অপমানিতও বোধ করেছেন কোনও কোনও বড় ব্যবসায়ী। এখন সকলের প্রতীক্ষা প্রাতঃপূজা সমাপনের।
অনেক অনেক দূরে প্রতীক্ষায় একদল মানুষ। নারী অথবা মেয়ে অথবা মহিলা, বিভিন্ন বয়সী। সকলেই আঙিনায়। যেখানে পা রেখেছিলেন সেই গেরুয়াধারী গৌরকান্তি যুবক। "মায়েরা" বলে সম্বোধন করেছিলেন তাঁদের। যেখানে তাঁরা সকলেই আজানু নত হয়ে প্রণাম করেছিলেন তাঁর পা ছুঁয়ে, সেখানে এখনও তাঁরা বিহ্বল। আজও তাঁদের ঘর তাঁরা নোংরা করবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা সমর্থনও করেছেন তাঁদের কোনও কোনও বাবু। কিন্তু শঙ্কা আছে তাদেরও। কি জানি ঠিক হল কি?
রেহানা এখানে নির্দ্বিধায় দুর্গা নাম নেয়, দুর্গা হয়ে যায় ময়না। সকলেই দুর্গা নাম স্মরণ করে, পীরের দরগায় মানত করে। ওলাবিবির পুজো পাঠায় বাবুদের হাত দিয়ে। এখানে ধর্ম নেই, জাত নেই। সকলেই আসে। কামরূপী পাপ রেখে ফিরে যায় সংসারে। যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত সেই পাপ কি কলুষিত করে নি গেরুয়ধারীকে! তাই এরা বিহ্বল, শঙ্কিতও।
পুজা শেষ। ধর্মাধিকারিক মন্দিরের দাওয়ায়। পাশে তাঁর গুরু। নলডাঙ্গার রাজসভা পন্ডিতের বংশধর। ইনি বালারও গুরু।
বাকি সকলেই পূজামন্ডপের আঙিনায়। বালাও।
"আমি নই, তোমার কর্ম-অকর্মের বিচার করবেন তোমার গুরু। তুমি ব্যাখ্যা করবে তোমার কর্ম-অকর্মের।"
ধর্মাধিকারীকের মৃদু গম্ভীর কথায় বালা মৌন সম্মতি দিলেন। তাকালেন গুরুর দিকে একবার। তারপর ধর্মাধিকারিকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
গুরু প্রশ্ন করলেন "তুমি গত রাতে কোথায় গিয়েছিলে? কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে এখন? সব ব্যাখ্যা করে বলো।"
"মাফ করবেন গুরুদেব, এখানে ধর্মাধিকারিক স্বয়ং উপস্থিত এবং এসময় আমার কাছে তিনিই শিবতুল্য। সুতরাং আমি তাঁর প্রতিই উত্তর দেব।"
গুরুর সম্মতি পেয়ে তরুণ সন্ন্যাসী বলতে লাগলেন,"সন্ন্যাসীর অগম্য কিছুই নয়। তাই আমার কোনও ভেদ জন্মায় নি। আমি দুঃখিত নই, আনন্দিত। তার কারণ সর্বজাতির পা পড়ে যেখানে তা মহাতীর্থ। তাই সেই মহাতীর্থের মাটি দেবী দুর্গার মহাস্নানের উপকরণ। আমি সেই তীর্থে দাঁড়াতে পেরেছি, শিব-কীর্তন করে এসেছি। সকলে যেখানে পাপরূপী কাম রেখে পালিয়ে আসে, তাঁদের পূজা করার কামনা আমি পূরণ করতে পেরেছি বলে আমি কৃতার্থ। আমি তাঁদের অতি সামান্য, কিন্তু শুদ্ধ এবং মন থেকে দেওয়া মাঙন নিয়ে এসেছি পূজার জন্য যা সর্বশ্রেষ্ঠ। সকাল হয়ে আসায়, সময় ছিল না বলে হাটে আর নাচ হয় নি। সেজন্য তাঁদের দেওয়া মাঙন আমার ভিক্ষা বলে বোধ হয়েছে। তাই তা ফেলে এসেছি। আমার আর কিছু বলার নেই।"
গুরু বিচার করলেন। বললেন "তুমি যা করেছ, সবই ধর্ম ও ন্যায় অনুসারী। কিন্তু যারা প্রতিবছর প্রতীক্ষায় থাকে তাদের দানও ভিক্ষা বলে প্রত্যাখ্যান করা অনুচিত।"
তিনি প্রস্তাব দিলেন সম্ভব হলে পরের বার থেকে সন্ন্যাসীরা সকালেই চলে যাবে হাটে, দুপুরে অভাগীদের মাঙনে রান্না-খাওয়া করে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত দুই জায়গাতেই নাচ-গান ইত্যাদি শেষে হাটের মাঙন পূজার জন্য নিয়ে ফিরবে পরদিন।
ধর্মাধিকারিক সেদিনই নিশ্চিত হয়েছিলেন বালা শীঘ্রই শিবত্ব অর্জন করবেন।