সংস্কার; কু অথবা সু
জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
Published on : 5/25/2021 1:11:00 AM
কেন মানব সংস্কার? কোনটাই বা মানব আর বর্জনীয়ই বা কোনটা? এই প্রশ্ন যে জাতির মধ্যে থাকবে এবং যতদিন থাকবে, সে জাতি থাকবে সচল এবং জীবন্ত। যে জাতি এ প্রশ্ন করতে ভুলে যাবে, অথবা এ প্রশ্ন নিতান্তই প্রাচীনপন্থী বোধ করে এড়িয়ে চলবে, সে জাতি আপন ঐতিহ্য-পরম্পরা এই সবই বিস্মৃত হবে।
সংস্কার একটি জাতির আপন বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পরম্পরার নিরিখে উৎপন্ন। সংস্কার তাই ধর্মের নিজস্ব সম্পদ নয়। ধর্মের নিজস্ব যা কিছু তা সংস্কার নয়, অনুশাসন। বরং বলা ভাল তা আচার-বিধি-রীতি-নীতি। সংস্কার হল ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক পরিমার্জন। তা কোনও ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য গড়ে উঠেছে, আবার কখনও কোনও অপকর্ষতা অপনয়নের জন্য। এটা হতেই পারে, এবং হয়েছেও যে ধর্মীয় রীতি-নীতির পরিমার্জনই হয়েছে বেশি, এবং সেজন্য সংস্কারকে ধর্মীয় বিধির সাথে একাসনে বসাতে অনেকেই দ্বিধা করেন না। কিন্তু সর্বদাই প্রায় সব ধর্মেই ধর্মীয় বিধি সংস্কারের অনুমোদন করে না। সুতরাং সংস্কার কিছুটা যেন ধর্মের রীতির একটু বিরোধিতাই করে। আসলে প্রাচীন কালে মানুষের সভ্য হওয়ার সূচনা থেকেই মানুষ তার মানসিক খিদে ও তা পূরণের তাগিদ অনুভব করে। এই মানসিক খিদের জন্য জীবনযাত্রার যে পরিমার্জন তাই সংস্কার। যেমন আহত সহযোগীর জন্য কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার, খাদ্য অল্প সংগৃহীত হলে সকলেই কিছু কিছু করে ত্যাগ স্বীকার করে ভাগ করে নেওয়া ইত্যাদি। এ সকলের সাথে ধর্মের যোগ হয়েছে পরে, মূলতঃ আত্মতৃপ্তির প্রবণতার জন্যই এ তাগিদের সৃষ্টি। সহমর্মী হয়ে আত্মতৃপ্তি, ভালবেসে আত্মতৃপ্তি। এর পর এই আত্মতৃপ্তির সামাজিক সর্বজনমান্যতা প্রদানের জন্য প্রয়োজন হল একে ধর্মের নিগড়ে বাঁধার। সে জন্য তৈরী হল ধর্মীয় চরিত্রদের উপর আরোপিত হতে লাগল ভালবাসার আত্মত্যাগের গুণ, সমবেদনা, ত্যাগ মানুষের জন্য কষ্টস্বীকার ইত্যাদি।
এরপর হল মানসিক চাহিদার আরও বিকাশ। যেহেতু সেই আদিকালে সমাজের উপর ধর্মের নিয়ন্ত্রণ ছিল সীমাহীন, সেজন্য এই ক্রমবর্ধমান মানসিক চাহিদা ও মননশীলতার বিকাশ ধর্মের সাহচর্য ব্যতীত সম্ভব ছিল না। তাই গান, নাচ, ছবি, এমনকি খেলা সবেতেই ধর্মের ছোঁয়া রইল। কিন্তু এ ছিল সংস্কারের অন্যতম ফসল, ধর্মের নয়। সেজন্যই এর পরিচয় সংস্কৃতি।
সংস্কার অবশ্যই একসময় ছিল নিদিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ। বিশ্বায়নের বহু আগে, ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সময় থেকেই সংস্কারের ভৌগলিক সীমা লুপ্ত হতে শুরু করে যার সম্পূর্ণ পরিসমাপ্তি বিশ্বায়নে। ইউরোপীয় সংস্কার অশুভ তেরো আজ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অনেকেরই অবচেতনে বিকশিত। আবার নিতান্তই বাংলার 'গায়ে-হলুদ' আজ আর একান্তই হিন্দু বাঙালীর সংস্কার নয়, অ-বঙ্গভাষী এবং অ-হিন্দু (বাঙালী মুসলমান) এ সংস্কার গ্রহণ করেছে নির্দ্বিধায়। এরকম সু অথবা কু যে সংস্কারই হোক, উৎস খুঁজলে দেখা যাবে প্রায় সবেরই শেকড় ধর্ম থেকে অনেক বেশি প্রোথিত সমাজ জীবনের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক পরিমার্জনের প্রয়োজনে।
এখন তাহলে কোনটি মানব আর কোনটি নয়? অথবা কোনটি সু আর কোনটি কু? বিশ্লেষণ করার জন্য প্রথম প্রয়োজন সংস্কারের জন্ম যে সময়ে সে সময় ও বর্তমান সময়ের সমাজের বিবর্তন ও পার্থক্য নিরূপণ করা। ইজরায়েলের কৃষি-প্রযুক্তি ব্যবহারকারী কৃষকের কাছে 'খনার বচন' 'যদি বর্ষে ফাগুনে/রাজা যান মাগুনে' তাৎপর্যহীন। ফাল্গুনের বৃষ্টি আলু-পেঁয়াজ প্রায় সর্বতোভাবে নষ্ট করে। সে যুগে হিমঘরও ছিল না। ফাল্গুনের বৃষ্টিতে নষ্ট হয় রবিশস্যও। সুতরাং খনা ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্না ছিলেন বোঝা যায়। আর সে যুগে তাই তার বচন প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। আর সেখান থেকেই এসেছিল সংস্কার। ধর্মের অপব্যাখ্যা ইত্যাদির হাত ধরে। আজও সেই সংস্কার থেকেই গ্রামের বৃদ্ধ শ্রাবণ মাসে কলা-কচু রোপণ করেন না। আর আধুনিকতার দোহাই দিয়ে খনাকে ও তার বচনকে কুসংস্কারের উৎস বলে দাগিয়ে দেই। খনার কৃতিত্ব, বাধ্য-বাধকতা বিচার বিশ্লেষণ করেও দেখি না, মর্যাদা দেওয়া তো দূরের কথা। যদিও সেই খনাকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করতে অবশ্য পিছপা হই না। অবশ্যই এ ধরণের সংস্কারের তা সে সু অথবা কু যাই হোক না কেন, আজ আর প্রয়োজন নেই।
'গায়ে-হলুদ' এর পেছনে পরিষ্কৃত-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বাসনা ও বিশেষ অনুষ্ঠানে এর প্রয়োজনীয়তা বিধান করে। সব দেশের সব কৃষকের চেয়ে বাংলার কৃষক নিঃসন্দেহে অধিক পরিচ্ছন্ন। অবশ্যই এর পেছনে বাংলার ভৌগলিক পরিবেশের গুরুত্বও অপরিসীম। তাও সে যুগের পরিচ্ছন্নতার অর্থ, সংজ্ঞা সবই আজ বহুল পরিবর্ধিত, পরিবর্তিত। আজ বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য মানুষ পেশাদার মানুষের পেশাদার ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভেষজ অথবা রাসায়নিকের উপর বেশি নির্ভরশীল। এই পরিস্থিতিতে সু হলেও এ ধরণের সংস্কার বয়ে চলার প্রয়োজনীয়তা সম্ভবত নেই। যা শুধুই মানার জন্য মানা, সে সংস্কার সু হলেও একসময় অর্থহীন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
তাহলে যার কিছুমাত্রও ভূমিকা আছে ব্যক্তি ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে সমাজের উৎকর্ষতা বিধানে, সে সংস্কার সু। অন্যথায় কু। এবং কোনও সংস্কার মানার উপযোগিতা গুরুত্বহীন হলে তা মানাও অর্থহীন পণ্ডশ্রম। যে সামান্য লবণ রাখা না রাখার সংস্কার পালনের যৌক্তিকতা বিচারের জন্য বৌদ্ধ সমাজ হীনযান ও মহাযান এই দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল সেই দেড় হাজারেও বেশি বছর আগে, আজ তার গুরুত্ব কট্টরপন্থীদের জন্যও কতটুকু!
তাহলে এভাবে দেখলে তো সবই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে! আসলে তা নয়। ধর্মীয় বিবাহ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন লোকাচার, যা হয়তো বর্তমানকালে তার উপযোগিতা হারিয়েছে, তা এখনও দেখা যায় পারিবারিক চেতনা ও বন্ধনকে দৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সুতরাং সে সব লোকাচার পালনীয় বিবেচনায় পালন না করে পারিবারিক বন্ধনের সূত্র বিবেচনায় পালন করলে উপভোগ্য হবে নিশ্চিত।