নীলপূজা
জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
Published on : 5/25/2021 1:11:00 AM
হিন্দু বাঙালীর সাড়ম্বরে পালিত উৎসবের মধ্যে মুখ্য দে'ল-দোল-দুর্গোৎসব। অবস্থাপন্ন পরিবার ছাড়া এই তিনটির আয়োজন কার্যত অসম্ভব। দুর্গোৎসবের মতো বহুল প্রচলিত না হলেও দে'ল বা দেউল পূজা অর্থাৎ, চড়ক পূজা জাঁকজমকে নেহাৎ সামান্য নয়। নীলপূজা বা হাজরাপূজা বা গাজন নামেও এর প্রসিদ্ধি।
এত বড় উৎসবের উদ্ভব কোথা থেকে সে ব্যাপারে ইতিহাস নিরুত্তর। কেউ কেউ বলেন অষ্টাদশ পুরাণ-বেদ-উপনিষদ কোথাও এর সম্যক বিধি খুঁজে পাওয়া যায়না। দে'ল, সাঙ্গা বা সং, বালা, রায়বালা, ধর্মাধিকারিক ইত্যাদি তথাকথিত অপশব্দের বহুল প্রয়োগ এবং বর্ণেতর ব্যক্তির পূজার অধিকার এবং ব্রাহ্মণ ও বর্ণেতরর সমানাধিকারযুক্ত সন্ন্যাসীর ন্যায় জীবনচর্যা (চৈত্রমাসব্যাপি অপারগ অর্থে চৈত্র সংক্রান্তির কিছু দিন আগে থেকে), ভাষারচিত মন্ত্রের পাঠ ইত্যাদি থেকে সমালোচকদের সিদ্ধান্ত সম্ভবতঃ তান্ত্রিক বৌদ্ধদের রীতি ছাঁটকাট করে হিন্দুরা গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে চড়কপূজাপদ্ধতি বইটির লেখক নলডাঙ্গার রাজসভা পন্ডিত নৃসিংহ প্রসাদ তর্করত্ন মহাশয়ের ব্যাক্তিগত মতামত, বাংলাদেশের বাইরে মাদ্রাজে প্রদেশেও চড়ক পূজার ব্যাপ্তি ও প্রসার, "বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের রীতি থেকে এই উৎসবের আগমন" -এই মতকে সমর্থন করেনা। এই অনুসন্ধানের গভীরে প্রবেশের নিমিত্ত যে যে বিষয়গুলি প্রথমেই জানা আবশ্যক, তা বরং প্রথমে আলোচনা করা যাক। যেমন- 'খাটনা খাটা' (অপশব্দ, সম্ভবতঃ অর্থ ঈশ্বরের প্রতি শ্রম দান), 'কাচ খেলা' (অপশব্দ, সম্ভবতঃ অর্থ ঈশ্বরের গুণকীর্তন), 'ঝাঁপান' (অপশব্দ, সম্ভবতঃ ধারালো বঁটি, খেঁজুর কাঁটা ইত্যাদির উপরে ঝাঁপ), 'চড়ক' (শিবানুগ্রহে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক চড়ক অথবা অপশব্দ, সম্ভবতঃ অর্থ চরকি ইত্যাদির ন্যায় ঘুর্ণন)।
খাটনা-খাটা: দেবাদিদেব মহাদেবের উপাসনার মূল স্তম্ভ কৃচ্ছসাধন, জ্ঞানার্জন ও এই দুইয়ের মাধ্যমে অনন্দলাভ। কালের প্রভাবে কৃচ্ছসাধনের বিভিন্ন পথগুলি শারীরিক আত্মনিপীড়ন ও মানুষকে বিস্ময়াবিষ্ট করার প্রয়াসে পর্যবসিত হয়েছে। তবু এই সকল পথই আপামর সকলের পক্ষেই সহজগ্রাহ্য ও আকর্ষণীয় পথ। এর একটি 'খাটনা-খাটা'। খাটনা-খাটা মূলতঃ কৃচ্ছসাধন ও আনুষঙ্গিক অনুকূল পরিবেশকে অবলম্বন করে একনিষ্ঠ হয়ে সাধনার উপায়। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বড় শক্ত। পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের পাঁচরকম গতি! ধুনোর গন্ধে যখন উদ্দীপক, আকর্ষক, কু-সু সকল গন্ধকেই ঢেকে দেয়, চোখের সামনে সাধকের উপাস্যের প্রতীক সেসময় ঢাকের তালে ছন্দ অনুসরণ করে কৃচ্ছসাধন সহজেই অন্যান্য সকল ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণলাভ করে।
খাটনা-খাটার একটি রীতি শস্য বা ধানের আবিষ্কর্তা শিবের প্রতি নাচের ছন্দে নিবেদিত। মূলতঃ ভারতনাট্যমের ছন্দ অনুসরণ করলেও এগুলি নাচ নয় উপাসনার সহজ কিছু রীতি। বীজ বপন থেকে ফসল তোলা পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিষয়টি রূপকমাত্র!
অন্য একটি মৎস্যশিকার। জেলেদের বিশ্বাস শিব জাল ফেলে মাছ ধরা শিখিয়েছেন। সংসারের জাল যিনি ফেলেন তিনি "মৎ", "স" অর্থাৎ নিজেকেই সংসারে আবদ্ধ করে নিজেরই (জেলে) ভক্ষ হন। এই জালের নিয়ন্ত্রণও আবার নিজের হাতেই!
সহজার্থে আরও একটি আছে, যা কোনও রূপক বা কিছুর দ্যোতক নয়, কিন্তু বহুল প্রচলিত।
সাঙ্গা : সাঙ্গা বা সাঙা বা সং মূলতঃ ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত শব্দ হলেও এক্ষেত্রে বিশেষ অর্থবাহী। অনেকের ধারণা গাজন উৎসবে সং সেজে দেব-দেবীর কীর্তনাদি করা হয় বলে ব্যাপক অর্থে গাজনের সন্ন্যাসীদের সং, সাঙা বা সাঙ্গা বলে ডাকা হয়। আদতে গভীর দর্শনবোধ থেকে সম্ভবতঃ বৌদ্ধ তান্ত্রিক এবং কিছু শৈব জ্ঞানাচারী তান্ত্রিক এই বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এ সংসারে সবই মিথ্যে অর্থাৎ 'সং' 'সার'। অর্থাৎ সংসারের সার বস্তু সং যা নিজেই মিথ্যে অভিনয় মাত্র। এই মতের সমর্থনে প্রাচীন বাংলার 'চর্যাচর্য বিনিশ্চয়' উল্লেখ্য।এই উপলব্ধি থেকেই বহিরঙ্গের রূপকে সং উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সাঙ্গা এখানে অন্য অর্থ। সম্ভবত সাঙ্গ করেন যিনি। মূলতঃ সন্ন্যাসীদের মধ্যে প্রধান সন্ন্যাসীকে সাঙ্গা বলা হয়। তিনি পাট মাথায় করে যথাবিধি স্নান পূর্বক সকলের গার্হস্থ্য জীবনের সাঙ্গ করেন এবং সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত করেন। আবার পূজা অন্তে পুনরায় যথাবিধি পাটস্নান পূর্বক সাঙ্গা সন্ন্যাস জীবনের অন্ত ঘটান এবং পুনরায় গার্হস্থ্য জীবনের দ্বার উন্মুক্ত করেন।