অমর ভারত কথা
জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
Published on : 7/19/2023 3:14:00 PM
দশাংশিক-এর মনে পড়ে নামকরণ উৎসব। মনে পড়ে তার সম্প্রদায়ের মানুষের উপাসনা পদ্ধতি, লৌকিক আচার। মনে পড়ে আরও অনেককিছু। কিন্তু সব কোথায় ভেসে যায় সাধুকে দেখলেই। একটা অমোঘ আকর্ষণে নিজের সম্প্রদায়, সমাজ, ঘর-সংসার সব ছেড়ে এসেছে সে। এমনকি ছেড়ে এসেছে নিজের নামও। একটি উট জবাই হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে তা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে আত্মীয়দের মুখে শুনে শুনে।
দশ মানে বহু মানুষকে বোঝায়। আবার দশ মনে মানুষের মধ্যে বিশেষ বিশেষ কিছু মানুষকেও বোঝায়। দশ মানে মানুষের একটি সমাজকেও বোঝায়। সেই দশের অংশ বলেই সাধু নাম রেখেছিলেন দশাংশিক।
একটি আঠারো বছর বয়সের ছেলে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একটি বৃদ্ধ সাধুর টানে নিজের নাম পর্যন্ত ছেড়ে আসতে পারে! এটাই কি ত্যাগ?
দশাংশিক ভাবছিল চুপচাপ। সাধু ধুনির সামনে বসে কিছু চিন্তা করছেন, মগ্ন। আর দশাংশিক সামান্য দূরে আপন চিন্তায়। আজ সাধুর উপবাস। সেজন্য দশাংশিকও জেদ করেই উপবাসে। সাধুর আপত্তি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন অন্নপ্রসাদ মেলে নি অন্নপূর্ণার মন্দিরেই, সাধু আর কিছু বলেন নি। কিন্তু এখন এই সদ্যোত্তীর্ণ সন্ধ্যায় সাধু যখন সাধনায় মগ্ন, দশাংশিক অনুভব করছে জলের তীব্র অভাব। সুতরাং কষ্ট ভোলার একমাত্র উপায় গভীর চিন্তন!
কেউ তো কই দূরে ঠেলে দেয় নি দশাংশিককে। অথচ কই সাধু তো না দিলেন গেরুয়া, না করলেন কোন শুদ্ধি আচার। দশাংশিক মেলাতে পারে না মানুষটিকে। সু-তর্ক যদি মানবিক হয় তবে তা অমূল্য। সেই অমূল্য সম্পদে সাধু সম্পদশালী। হয়তো সেজন্যই যা কিছু ধারণা নিয়ে বড় হওয়া সবই কেমন গুটিয়ে যায় সাধুর যুক্তির সামনে।
সাধু হঠাৎ সম্বোধন করলেন দশাংশিককে। বললেন একটু জল নিয়ে আসতে কমন্ডলুতে। আর ঝোলা থেকে বার করলেন দুটি শুকনো ডেলা। দুধের সর জমানো। মিষ্টি এই সর ভীষণ দ্রুত শরীরে শক্তি যোগায়, শরীর গরম রাখে। কিন্তু সাধু হঠাৎ এখন জল খাবেন কেন? এখনও তো সমাপ্ত হয় নি সাধনা। তবে!
সাধু জমানো সরের সামান্য একটু ভেঙে মুখে দিলেন। জলপান করলেন সামান্য। তারপর বাকি মিষ্টি, জল বাড়িয়ে দিলেন দশাংশিকের দিকে। আশ্চর্য হলেও দশাংশিক খেতে শুরু করলে সাধু বলতে শুরু করলেন, "বুদ্ধ তখন অস্থিসার। মহাতপস্যায় লীন থেকেও কোন লাভ হয় নি বিশেষ। প্রাপ্তির খাতায় শূন্য। মন অসংযত হচ্ছে খিদে আর তৃষ্ণায়। মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার যত উপায় জানা আছে, কোনটাই কাজে লাগছে না, এমন সময় দেখলেন একজন সঙ্গীতকার যাচ্ছেন, সঙ্গে তাঁর শিষ্য। শিষ্য জিজ্ঞাসা করছে বীণার তার কীভাবে বাঁধা উচিৎ। গুরু উত্তর দিলেন, "তারের বাঁধন না হবে খুব শক্ত, না আলগা। তার আলগা হলে সুর বসবে না। আর তার যদি খুব শক্ত হয় তো সুর যখন জমে উঠবে সপ্তমে, ছিঁড়ে গিয়ে রসভঙ্গের কারণ হবে।"
সিদ্ধার্থের মনে হল এ যেন মহাগুরুর অমোঘ বাণী। যেন সাধনা হল বীণার তার। আর সুর হল ইষ্ট। সাধনা আলগা হলে সিদ্ধি অসম্ভব। কিন্তু সাধনা যদি হয় অত্যন্ত সুকঠিন, শক্ত, তবে হয়তো সকল শক্তি ঈপ্সিতকে পেতেই ব্যয় হয়ে যাবে, ইষ্টলাভের পর তা ধারণ করার সামর্থ্য আর থাকবে না। সুতরাং শ্রেষ্ঠপথ মধ্যমপন্থা। বীণার তারের বাঁধনের মতই মাঝঝিম পথ। সিদ্ধার্থ তখনও বোধিলাভ করে বুদ্ধদেব হয়ে ওঠেন নি। জীবনে উপলব্ধ এরকম বিভিন্ন অমূল্য ছোট ছোট বাস্তববোধই তাঁকে সামগ্রিক বুদ্ধ করে তুলেছিল।
দশাংশিক বুঝতে পারছিল গুরু কেন তার উপবাসের বিরোধী। কিন্তু মনে এও প্রশ্ন এল, গুরু নিজে যে উপবাসক্ষীণ। ঠিক তখনই সাধু আবার বলতে শুরু করলেন।
আরুণীপুত্র উদ্দালক ছিলেন মহাজ্ঞানী। তিনি তাঁর পুত্র শ্বেতকেতুকে বারো বছর বয়সে গুরুগৃহে পাঠান। শ্বেতকেতু বারো বছর পড়াশোনা করে যখন ফিরে এল তখন সে অহংকারে পূর্ণ। শ্বেতকেতু গুরুর কাছে অধ্যয়ন করে এসেছেন সমগ্র বেদ-সংহিতা। সম্পূর্ণই তাঁর জিহ্বাগ্রে। তা দেখে উদ্দালক প্রশ্ন করলেন কী সৎ(অস্তিত্ব)। কী তাঁর প্রকাশ? শ্বেতকেতুর কাছে উত্তর ছিল না। শ্বেতকেতুর জানা ছিল না কী সেই চরম অস্তিত্ব যা অব্যয়। অহংকার খর্ব হল শ্বেতকেতুর। তিনি বুঝলেন শিক্ষা এখনও অসম্পূর্ণ। শ্বেতকেতু বাবার কাছে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রার্থনা করলেন। উদ্দালক তখন বললেন, "দেখ বাছা, অন্নই ব্রহ্ম। এর স্থূল অংশ বর্জ্য মল, সার অংশ ষোলকলার এই শরীর এবং সূক্ষ্ম অংশই চেতনা-মন-বুদ্ধি। তেমনি জল ব্রহ্ম। জলের স্থূল অংশ বর্জ্য মল, সার অংশ রক্ত-রস এবং সূক্ষ্ম অংশ প্রাণ। এই জল যেহেতু সূক্ষ্ম অর্থে প্রাণ তাই তুমি আগামী পনেরদিন কেবল জল খেয়ে থাকবে। এতে করে তোমার প্রাণ থাকবে। বাস্তববুদ্ধি থেকে আমি কেন অন্নকেই সৎ(অস্তিত্ব) ও ব্রহ্ম বলেছি তা তখন বোঝাতে খানিক সহজ হবে।"
পনেরো দিন পর শ্বেতকেতু বাবার কাছে এলে দেখা গেল তিনি বেদ স্মরণ করতেও অক্ষম। উদ্দালক বললেন "ষোলকলার পনেরোদিন কেবল জলপান করে থাকায় অন্নরূপী শরীরের মাত্র একটি কলাই অবশিষ্ট যা বেদ স্মরণ, ধারণ কিছুই করতে সক্ষম নয়। কেবল জলপান করার কারণে জলরূপী প্রাণ রয়েছে, তেজরূপী বাকও গিয়েছে নষ্ট হয়ে। সুতরাং এখন আলোচনা বৃথা। তুমি বরং আগামী পনেরোদিন ঠিক ততটুকুই অন্ন-জল গ্রহণ করবে যা না অতিরিক্ত না কম।"
এরপরের পনেরো দিন শ্বেতকেতু যথাযথ খাওয়া-দাওয়া করার পর বেদ স্মরণ করতেও যেমন সক্ষম হলেন তেমনই সক্ষম হলেন বাবার বাস্তববাদী কথা বুঝতে।
দশাংশিক বুঝল উদ্দালকের মতো পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ না এলে কঠোর উপাসনা অর্থহীন। কঠোর পথ সকলের জন্য নয়ও। আর যাঁর পরিপূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ এসেছে, তাঁর কাছে আর কঠোরই বা কী আর কোমলই বা কী! সুতরাং সাধারণ সকলের জন্য মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ, তা সে সংসার হোক বা সন্ন্যাস, ভোগ হোক বা ত্যাগ।